“আজীবন আইন মেনেছি। মৃত্যুতে আইন ভাঙব কেন” – সক্রেটিস

মহাজ্ঞানী সক্রেটিস
মহাজ্ঞানী সক্রেটিস

মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে সন্ধ্যায়। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের সকলেই আর একান্ত শিষ্যরা তার চারপাশ ঘিরে আছেন, কারাগারের অন্ধকার ঘরে! প্রধান কারারক্ষী এসে শেষ বিদায় নিয়ে গেলেন. তার চোখেও অশ্রু টলমল করছে। হায় কি অদ্ভুত শাস্তি! যে মরবে সে ধীরস্থির ও শান্ত। আর যে মারবে তার চোখে জল।

 

কারাগার প্রধান বললেন- “এথেন্সের হে মহান সন্তান- আপনি আমায় অভিশাপ দিবেন না, আমি দায়িত্ব পালন করছি মাত্র”। এতবছর কারাগারে কাজ করতে গিয়ে আপনার মতো সাহসী, সৎ ও জ্ঞানী কাউকে আমি কখনো দেখিনি। ‌‌মৃত্যুর ঠিক আগে সক্রেটিস তার পরিবারের নারী ও শিশুদের চলে যেতে বললেন। সুন্দর পোষাক পরলেন তিনি। শিষ্যরা সবাই কাঁদছে কিন্তু সক্রেটিস যেন বেপরোয়া। মৃত্যুতে কি কিছুই যায় আসে না তার? মৃত্যুদন্ডটা চাইলেই তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন ! ‌‌

 

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো:- দেবতাদের প্রতি ভিন্নমত প্রকাশ। রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র ও তরুণদের বিপথগামী হতে উৎসাহ প্রদান।‌‌ নিয়ম অনুযায়ী খোলা মাঠে তার বিচার বসেছিলো। বিচারক ছিলেন তৎকালীন সমাজের ৫০০ জন জ্ঞানী মানুষ। এদের অনেকেই ছিলেন গ্রীসের রাজার একান্ত অনুগত। সক্রেটিসের মেধা ও বিশেষত তরুণদের কাছে তার জনপ্রিয়তায় জ্বলন ছিলো তাদের। ‌‌

 

সক্রেটিসকে খতম করার এমন সুযোগ তারা ছাড়বে কেন ? তবুও হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন সক্রেটিস, কিন্তু কাঠ গড়ায় দাঁড়িয়েও বিচারকদের নিয়ে উপহাস করতে ভুললেন না। ফলাফল হেমলক লতার বিষপানে মৃত্যু। সক্রেটিস নিজেই তার আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন। কঠোর যুক্তি দিয়ে বিচারকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিলেন। বিচারকেরা তার একটি প্রশ্নেরও সঠিক কোন উত্তর দিতে পারেনি। ‌‌‌‌

 

মৃত্যুর আগে একমাস কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি। নিয়ম ছিলো এমন। এই একমাসে কারারক্ষীরাও তার জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে গেলো। তারা তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে চাইলো।‌‌ সক্রেটিস বিনয়ের সাথে না করে দিলেন। বললেন আজ পালিয়ে গেলে ইতিহাস আমায় কাপুরুষ ভাববে। তিনি মনে করতেন বীরের মতো মৃত্যু অপমানের জীবনের চাইতে শ্রেষ্ঠ বলে! ‌‌

 

ঐদিন সন্ধ্যায় প্রধান কারারক্ষী চলে যাওয়ার পরে জল্লাদ এলো পেয়ালা হাতে, পেয়ালা ভর্তি হেমলকের বিষ। সক্রেটিস জল্লাদকে বললেন কি করতে হবে আমায় বলে দাও। ‌জল্লাদ বললো, পেয়ালার পুরোটা বিষ পান করতে হবে। একফোঁটাও নষ্ট করা যাবেনা। সক্রেটিস বললেন তবে তাই হোক। তিক্ত বিষের পুরো পেয়ালা তিনি জলের মতো করে পান করে ফেললেন। চারপাশে বসে থাকা শিষ্যরা চিৎকার করে কাঁদছেন, এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ।

 

তখন জল্লাদ আরও কঠোর নির্দেশটি দিলো। বললো নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে এখন কিছুক্ষণ পায়চারী করতে হবে। যাতে বিষের প্রভাব পুরোটা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হায় হায় করে উঠলেন সবাই। ‌‌শুধু ম্লান হাসলেন সক্রেটিস। বললেন আজীবন আইন মেনেছি। মৃত্যুতে আইন ভাঙবো কেন ? দূর্বল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটলেন কিছুক্ষণ। যতক্ষণ তার শক্তিতে কুলোয়। এরপর বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। শিষ্যদের বললেন, তোমরা উচ্চস্বরে কেঁদোনা। আমায় শান্তিতে মরতে দাও।

 

জল্লাদের পাষাণ মনেও তখন শ্রদ্ধার ভাব, বিনয়ে আর লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো সে। চাদর দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলেন সক্রেটিস। একবার চাদরটা সরালেন। একজন শিষ্যকে ডেকে বললেন প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা মুরগী ধার করেছিলাম আমি। ওটা ফেরত দিয়ে দিও। ‌‌

 

ঐদিন সক্রেটিসের মূত্যুর খবর এথেন্সে ছড়িয়ে পড়লে, সাধারণ মানুষেরা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে এথেন্সের রাস্তায় নেমে আসে ও সক্রেটিসের বিরুদ্ধে মিথ্যা রায় দেওয়া বিচারকদের পিটিয়ে হত্যা করে। কিছু বিচারক ও জল্লাদ অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেছিলো।‌‌ এই ছিলো তার শেষ কথা। খানিক পরেই অনিশ্চিত যাত্রায় চলে গেলেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিস।

 

তার শিষ্যদের মাঝে সেরা ছিলেন প্লেটো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এই ঘটনাগুলো প্লেটো তার রচিত বিখ্যাত রিপাবলিক গ্রন্থে লিখে গুরুকে অমর করে গেছেন। ‌‌‌প্লেটোর শিষ্য ছিলেন মহাজ্ঞানী এ্যারিষ্টটল। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ দ্যা পলিটিক্স। এ্যারিষ্টটল ছিলেন সর্বকালের জ্ঞানী মানুষদের সামনের সারির একজন। আর মহাবীর আলেকজ্যান্ডার দ্যা গ্রেটের নাম আমরা সবাই জানি, এই বিশ্বজয়ী আলেকজ্যান্ডারের শিক্ষক ছিলেন এ্যারিষ্টটল। ‌‌প্রহসনের বিচারে সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মৃত্যু তাকে মারতে পারেনি। শিষ্যদের মাঝে জ্ঞানের আলো দিয়ে বেঁচে রইবেন তিনি অনন্তকাল।